পরিকল্পনার লক্ষ্য

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র | | NCTB BOOK
3

শুভ খেলাধুলায় খুবই ভালো । ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন সবই ভালো খেলে । তার সতীর্থ ইমন শুধু ক্রিকেট খেলে । শুভ কোনো খেলাতেই স্থানীয় পর্যায়ের গণ্ডি পেরুতে পারেনি । কিন্তু ইমন এখন জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলছে । ইমনের ভালো করার কারণ সে লক্ষ্য ঠিক করে সেভাবে পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে । যা শুভর পক্ষে সম্ভব হয়নি । ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অন্যতম লেখক অধ্যাপক নিউম্যান তাঁর Administrative Action গ্রন্থে একটা উদাহরণ দিয়ে লক্ষ্য ও পরিকল্পনার মধ্যকার সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটা বিমান সংস্থা তার কার্যক্রম নির্ধারণ, এয়ারক্রাফট সংগ্রহ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নির্বাচন, কর্মী সংগ্রহ ইত্যাদি যে কোনো কাজ শুরুর পূর্বে অবশ্যই স্থির করবে যে, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য যাত্রী পরিবহন না মালামাল পরিবহন ।' এটা ঠিক না। হলে কখনই পরিকল্পনা গ্রহণ ও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না ।

পরিকল্পনার অভিপ্রেত ফলকে লক্ষ্য বলে । পরিকল্পনা সবসময়ই লক্ষ্যাভিমুখী । লক্ষ্য নির্ধারণ যেমনি একটি পরিকল্পনা তেমনি এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কর্মপন্থা ঠিক করা হয় তাও পরিকল্পনা । মানুষ ভাল-মন্দ যা-ই করুক না কেন তার একটা লক্ষ্য থাকে । কারণ সচেতন মানুষ লক্ষ্যহীন উদভ্রান্তের মতো কোনো কাজ করতে পারে না । কাজ শুরুর পূর্বেই তার লক্ষ্য কী অর্থাৎ এ কাজ থেকে কী পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা বুঝে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে । অতঃপর তার আলোকে পরিকল্পনা প্রণীত হয়ে থাকে ।

ব্যবস্থাপনা একটি প্রক্রিয়া যার অধীনে পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্য পারস্পরিক ধারাবাহিকতায় সম্পন্ন হয় এবং তা নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পাদন করা হয়ে থাকে । তাই ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মূলে থাকে একটা লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়া হয় ও ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় । ধরা যাক, একটা প্রতিষ্ঠান আগামী বছরে তাদের বিক্রয়ের পরিমাণ ২৫% বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে । এখন সেভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজারজাতকরণ প্রসার কর্মসূচি তৈরি, বাজার সম্প্রসারণ, অর্থসংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা নেবে । প্রত্যেকটা বিভাগ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে অধিলক্ষ্য (Sub-goal) নির্ধারণ করবে ও সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবে । এভাবে লক্ষ্য সকল কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে । বিষয়টিকে নিম্নের রেখাচিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা যেতে পারে :

চিত্র : লক্ষ্যের সাথে পরিকল্পনা ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা কাজের সম্পর্ক

লক্ষ্যের প্রকারভেদ (Types of goal in plan)

লক্ষ্য একটা সাধারণ পরিভাষা । পরিকল্পনার ভিন্নতা থাকায় লক্ষ্যকেও নানানভাবে নানান অভিধায় নামকরণ করতে দেখা যায় । প্রতিষ্ঠান ভেদেও একেক স্থানে লক্ষ্যকে একেক নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিচারে বিষয়টিকে নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক) প্রকৃতি বিচারে:

১. উদ্দেশ্য (Objectives) : উদ্দেশ্য হলো অভিপ্রেত লক্ষ্য যাকে ঘিরে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় । যে কোনো কার্য সম্পাদনের পিছনে সম্পাদনকারীর একটা উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে । ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পিছনে ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন করা। একটা ক্লাব, পাঠাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ইত্যাদির ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে । যাকে ঘিরেই তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় । প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন, দূরকল্পনা বা সাধারণ উদ্দেশ্যকে (Vision) বলে ।

২. মিশন (Mission): মিশন লক্ষ্যের আরেকটি রূপ । ইংরেজি Mission শব্দের বাংলা অর্থ হলো ব্রত, সাধনা বা প্রচেষ্টা । পূর্বে মিশন শব্দটি ধর্মীয় ব্রত বা সাধনার সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা হলেও এখন সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানেই মিশন শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উন্নত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের প্রয়াসকে মিশন হিসেবে দেখা যায়। একটা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ‘উত্তম ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন'কে মিশন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে । তাই মিশন কর্মলক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত ।

৩. সময় লক্ষ্য (Time Goal): সময় লক্ষ্যও লক্ষ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা । একটা কাজ কত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে এটা নির্ধারণকেই সময় লক্ষ্য বলে । অনেক সময় এরূপ লক্ষ্য সকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্যবিন্দু বিবেচিত হয় । যেমন- একটা নির্মাণ কোম্পানি বিল্ডিং নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছে । তাদেরকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে দু'বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে অন্যথায় নির্মাণ চুক্তি বাতিল হবে এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে । এক্ষেত্রে দু'বছর সময়কে সময় লক্ষ্য বলা হবে ।

৪. বাজেট লক্ষ্য (Budget goal): প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত ফলাফল যখন সংখ্যায় প্রকাশ করা হয় তাকে বাজেট লক্ষ্য বলে । প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়, প্রাপ্তি-প্রদান ইত্যাদি আর্থিক অংককে সাধারণভাবে বাজেট মনে করা হয় । তবে সেক্ষেত্রে ঐ বাজেটের একটা লক্ষ্য থাকতে পারে যাকে বাজেট লক্ষ্য বা টার্গেট বলা হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বিগত বছরের তুলনায় ২৫% বৃদ্ধির লক্ষ্যকে বাজেট লক্ষ্য বলা যায়। এভাবে উৎপাদন বিভাগের এক লক্ষ একক পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে ৫০০ শিক্ষার্থী ভর্তির পরিকল্পনাকে বাজেট লক্ষ্য বা টার্গেট হিসেবে গণ্য করা যায় । যা লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে ।

খ) সাংগঠনিক স্তর বিচারে:

১. স্ট্র্যাটিজিক লক্ষ্য (Strategic goal): প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীগণ প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেন তাকে স্ট্র্যাটিজিক লক্ষ্য বলে । দশ বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মুনাফার হার ২০% এ উন্নীতকরণ, পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় বিভিন্ন মার্কেটে আরও নতুন তিনটি শাখা দোকান প্রতিষ্ঠা, পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রয়ের পরিমাণ বর্তমান অপেক্ষা তিন গুণ বৃদ্ধি ইত্যাদি এরূপ লক্ষ্যের উদাহরণ ।

২. বিভাগীয় বা কৌশলগত লক্ষ্য (Departmental or tactical goal): প্রতিষ্ঠানের মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ স্ট্র্যাটিজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেন তাকে বিভাগীয় বা কৌশলগত লক্ষ্য বলে । বিক্রয় বৃদ্ধির স্ট্র্যাটিজিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য একটা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিভাগ এক বছরে ২৫% উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । এটিকে উৎপাদন বিভাগের বিভাগীয় বা কৌশলগত লক্ষ্য বলা হবে ।

৩. কার্যসম্বন্ধীয় লক্ষ্য (Operational goal): প্রতিষ্ঠানের নিচের পর্যায়ের উপবিভাগ বা কর্মকেন্দ্রগুলোতে বিভাগীয় লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য যে সকল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তাকে কার্যসম্বন্ধীয় লক্ষ্য বলে । শ্রম ঘন্টার অপচয় রোধের জন্য যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে যে, যে কোনো মেশিনে ত্রুটি দেখা দেয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে তা অবশ্যই মেরামত করা হবে- এটি কার্যসম্বন্ধীয় লক্ষ্যের উদাহরণ ।

Content added By
Promotion